রিভিউ: যারা আগুন লাগায়
যারা আগুন লাগায় তাদের… “ধরো আর ঝোলাও। ধরো, আর ঝোলাও!” নাটকের শুরুতেই শহরের বর্তমান সমস্যার(?) সহজবোধ্য নিদান দেন বিডারম্যান, টেকো মাথায় চুল গজাবার তেল বিক্রি করে যিনি একজন ধনী ব্যাবসায়ী।
কে বা কারা যেন অতিথি হয়ে বাড়ির চিলেকোঠায় আশ্রয় নিচ্ছে, আর তারপর পরদিন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
নাটকের নাম “যারা আগুন লাগায়”। প্রযোজনা তৃতীয় সূত্র। পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। ম্যাক্স ফ্রিসচ এর “The Fire Raisers” অবলম্বনে নবারুণ ভট্টাচার্যের অনুবাদ। এবং তাতে নিয়ম মেনেই নিজস্বতার ছাপ রেখেছেন অনুবাদক। এ নাটকের উপস্থাপনা “গণতান্ত্রিক” দেশের গণতান্ত্রিক খামতিগুলোকে সঙ্গে নিয়েই। যে খামতিগুলোর কোন স্থান কাল চরিত্র থাকে না। তাই এই অনুবাদে শুধুমাত্র ভাষার পরিবর্তন হয়।
গল্পটা খানিকটা এরকম। বিডারম্যানের(অনির্বাণ ভট্টাচার্য) বাড়িতে একদিন চালচুলোহীন স্মিজ(গৌতম মৃধা) আসে যে নাকি আগে কোনো একসময় পালোয়ান ছিল। বিডারম্যান প্রশ্নাতীত ভাবে চেষ্টা করে যান নিজেকে এবং বাকি পৃথিবীকে বোঝানোর জন্য যে তিনি অত্যন্ত মানবদরদি একজন মানুষ;আসল সত্য যাই হোক না কেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে স্মিজ দিব্যি বিডারম্যানের বাড়ির রুটি, মদের সদব্যবহার করে, বিডারম্যানের বাড়ির চিলেকোঠায় তাঁরই কাপড় পরে শোয়। ইতিমধ্যে স্মিজের বন্ধু ইজেন্রিং তার সাথে থাকতে শুরু করে। এরা দুজন গোপনে চিলেকোঠায় পেট্রোলভর্তি ড্রাম জমা করে। এবং নিয়মিত বিডারম্যান কে জানিয়ে যায় যে তারাই আগুন লাগায় এবং শহরের অন্যান্য বাড়িগুলোতেও তারাই আগুন লাগিয়েছে। তাদের পরের কাজটা হল বিডারম্যানের বাড়িতে আগুন লাগানো!
নাটকের সবথেকে ভালো জায়গা হল শেষ টা, মুল নাটকের থেকে যা একেবারেই আলাদা। বিডারম্যান নিজে দেশলাই বাক্স এগিয়ে দেন স্মিজ ও তার বন্ধুকে, স্ত্রীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও! তাঁর ভয়ার্ত স্ত্রী(তমালি কক্কর) কারন জানতে চাইলে বলেন যে এদের সত্যিই আগুন লাগানোটাই উদ্দ্যেশ্য হলে, দেশলাই বাক্স টা অবশ্যই সঙ্গে করে আনতো!
মৌলিক অধিকার, ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্য, চিন্তা এবং ভাষার স্বাধীনতা… এই শব্দগুলো শুধু তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতীকী অলঙ্কার। যে বা যারা বা যা কিছু ক্ষমতার স্তম্ভ, রাষ্ট্র অথবা পুঁজিবাদী, সবাই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণকে ভয় পায়। কোন ব্যাক্তি বাকস্বাধীনতা অথবা নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন না হলে তা আখেরে রাষ্ট্রেরই লাভ। রাষ্ট্রের দ্বারা প্রতিনিয়ত পরোক্ষ চাপ যা মানুষের দৈননন্দিন জীবনচর্চার শর্ত হয়ে উঠেছে, কোন এক সময় কোন এক অবস্থায় তা আগ্নেয়গিরির লাভা হয়ে বেরিয়ে আসতেই পারে।
ইচ্ছা করেই হয়ত এই নাটকে চড়া দাগের, আবেগরঞ্জিত ডায়লগ রাখা হয়নি। অনির্বাণ এবং গৌতম দুজনেই কুর্নিশযোগ্য অভিনয় করেছেন। একবারের জন্যও মনে হয়নি অনির্বাণ স্বাভাবিক অবস্থায় এইভাবে কথা বলেন না বা হাঁটেন না। একইসঙ্গে নিরীহ এবং ভয়ঙ্কর কিরকম হওয়া যায় তা গৌতম দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ উল্লেখ করতে হয় অঙ্কিতা মাঝির। আন্না। বিডারম্যানের বাড়িতে কাজ করে। এবং দিনের পর দিন একই কাজ করে করে, একই আদেশ শুনে শুনে সে প্রায় রোবটের মতো আচরণ করে। এই নাটকের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে দেবজ্যোতি মিশ্র। কোরাসের পায়ের, লাঠির আওয়াজ আর ছড়ার মতো করে বলা কিছু লাইন দিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন। জমেনি।
সেট সাধারণ। দীনেশ পোদ্দারের আলো নাটকে অন্য মাত্রা যোগ করে।
আশার এটাই যে চিরাচরিত ভাবে নাটকের শেষ না করে পরিচালক দর্শক কে ভেবে নেওয়ার, ভাবার অবকাশ দিয়েছেন। হল থেকে বেরিয়ে তাই প্রশ্নটা থেকেই যায়… কারা আগুন লাগায়? আর যদি প্রশ্ন করি, কেন?
Animeshonly is the founder of hojelive. He has been into theatrics & literature from a very tender age. Apart from producing new content and events for the brand, he loves gazing at the sky, seeping balck coffee and listening to the meows of his cat.