মৃত্যুদশার শেষ দিনই জন্মদিন!
সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি মনে হয় যে আগের রাতে জীবদ্দশার শেষ রাত ছিল, সকালে মৃত মানুষ হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলাম… আন্দাজ করতে পারেন অনুভূতিটা কেমন হতে পারে?
ব্যাক্তিবিশেষে অবশ্য অনুভূতির পার্থক্য হতে পারে; তবে আমিআমার এই স্বপরিকল্পিত মৃত্যুদশাকে দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছি দুঃখ বিলাসী হয়ে দুঃখ পেয়ে… দুঃখ পেয়ে দুর্বল হয়ে, দুর্বল হয়ে আলসেমিতে!
বছর ফুরোলে নতুন বছর শুরু হবার মুখে অন্য কয়েক’শ হাজার পশ্চিমিরীতির পালনের ঘনঘটার মত ‘নিউ ইয়ার রেজলিউশান’ বলে একটা বেশ জনপ্রিয় শব্দ শোনা যায়। লোকজন নাকি লিস্ট বানায় নতুন বছরে কি করবে- কি করবে না, কি কি অভ্যেস ছাড়বে অথবা তৈরি করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই রেজিলিউশান ব্যাপারটা জন্মদিন এলেও পালন করা যায় ও হয়। এবং যে বা যারা কখনও কোনোদিন একবার অন্তত এটা প্র্যাকটিস করেছেন তাঁদের মধ্যে আমিও পড়ি। সেই তখন থেকে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি জন্মদিন মানে একটা স্পেশাল ব্যাপার(সেটা খুব ছোট বয়স থেকে নয়)! জন্মদিনটা আর বাকি দিনগুলোর থেকে আলাদা। জন্মদিনে নাকি প্রচুর আনন্দ করতে হয়, ফুর্তি করতে হয়- ‘কেক’ খেতে হয়- মায়েদের নাকি ‘পায়েস’ই রাঁধতে হয়বা আরও অনেক কিছু।
গ্রামে মানুষ হয়েছি। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। কারোর জন্মদিন মনে রাখা, ‘উইশ’ করা- জন্মদিন পালন করা- এগুলো শুধু টিভিতে দেখতাম। এবং আমার বা আমাদের জন্মদিন কেন পালন করা হয়না- এ নিয়ে কোনওদিন কোন আক্ষেপ ছিল না। কারন আনন্দ অথবা খুশির খোরাকের জন্য আমরা অন্য কোন উৎসের খোঁজ করে নিতাম। তাই দিওয়ালি বা দীপাবলিতে ‘দোদমা’ অথবা ‘কেন্নো চরকি’ পোড়াতেই হবে বলে মনে হয়নি কখনও। হয়ত আরও অন্যান্য যারা আমার মতো নিম্নমধ্যবিত্ত যৌথ পরিবারে মানুষ তারাও একই অবস্থার শিকার।
প্রায় একুশ বছর বয়সে আমি জীবনে প্রথমবার জন্মদিনের কেক কাটি, মানে আমার ‘জন্মদিন পালন’ করা হয়। যে ভাবে করতে হয় আর কি! জেঠতুতো দাদার স্নেহে। দাদর মেসে হাফ প্যান্ট আর ফতুয়া গেঞ্জি পরে স্টিলের থালার ওপর রাখা কেকটায় পোঁতা মোমবাতিগুলোয় ফুঁ দিতে প্রচুর লজ্জা পেয়েছিলাম। আমি শুধু টিভিতে দেখা জন্মদিনের অনুষ্ঠান মনে করে অনুকরণ করার চেষ্টা করছিলাম। আর তারপর কলকাতা শহরে আরও দু-তিন বছর। শহুরে বন্ধুবান্ধব- ফেসবুক- অফিস- মেস ইত্যাদি, রেওয়াজ- লৌকিকতা! প্রত্যেক বছর আমায় কমপক্ষে তিনটে আলাদা জায়গায় তিনখানা কেক কেটে জন্মদিন সেলিব্রেট করতে হয়। আরও একটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না বললেই নয়…
আগে মা শুধু নিঃশব্দে- আমারই জন্মদিন আমাকে না জানিয়ে (জানানোর বিশেষত্ব অস্বীকার করেই বোধহয়) গ্রামের শিবমন্দিরে গিয়ে আমার নামে পুজো দিয়ে আসতেন। এখনও সেটাই করেন। তফাত হল এখন ফোন করে ইংরেজিতে হ্যাপি বার্থডে উইশ করেন। বোনও। দিদাও।
একটা অদ্ভুত উন্নাসিকতায় ভুগতে ইচ্ছে করে। এর আগে কখনও এরকম ভাবতে ইচ্ছে হয়নি। এখন হচ্ছে। প্রচণ্ড অস্বস্তি হয় জন্মদিন এগিয়ে এলে। অথবা জন্মদিনেরদিন। মনে হয় যত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যায় মঙ্গল। সেলিব্রিটি নাকি। পৃথিবীতে রোজ কোটি কোটি মানুষ জন্ম নিচ্ছে- মরছেও। কত শতাংশ মনে করে জন্মদিন পালন করা উচিত? জন্মদিন কাকে বলে- খায় না মাথায় দেয়- কতজন জানে? কি এসে যায় আসলে? শুধু জন্মদিনেই বয়স বাড়ে- অথবা ‘আমি বেঁচে আছি’ এই অনুভূতিটা আসে? সত্যিই কি তাই? সকালে খবরের কাগজ জানতে পারলাম 18th মার্চ নাকি coolest day! সৌজন্যে snapdeal! ঘর থেকে বেরবার আগে কয়েকডজন প্রতিশ্রুতি বিলোতে হল- জমিয়ে খাওয়াব…যে যা খেতে চায়, আমার জন্মদিন বলে কথা। অফিস যাওয়ার পথে গঙ্গা পার হতে হয়। আজ দেখলাম গঙ্গার জলে প্রচুর কচুরিপানা। আমাদের গ্রামের জমে যাওয়া ডোবা মনে হল। পানাগুলোর যেন কোথাও যাওয়ার নেই। অসহায় মনে হল। পরপর কিছু কথা মনে পড়ল।
বিজ্ঞাপনে বললঃ আজ নাকি coolest day!
হরস্কোপে বললঃ আজ নাকি আমি সাহসী হব।
ক্যালেন্ডারে বললঃ আজ আমি আরও একবছর মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেলাম।
ওয়ালেট বললঃ আমি এখনও পার্থিব জগতে কোথাও এগিয়ে পৌঁছতে পারিনি।
ডানহাতের কব্জিটা ছুঁয়ে দেখলাম- মনে হোল আমি আগের বছরের চেয়ে আরও রোগা হয়ে গেছি।
এতকিছু ভেবে আমার কোঁচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে গেলো। শালা এই জন্মদিন ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে দেখছি। চাপ খাইয়ে দেয়!
লঞ্চঘাটে টিকিট কাউনটারে কয়েকটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে কে দেখি। চিরাচরিত ভাবে ‘ভিখিরির বাচ্চা’ অথবা ‘ভিখিরি বাচ্চা’রা যেমন দেখতে হয় সেরকম দেখতে ওদেরকে। টিকিট কাটতে আসা লোকেদের কাছে পয়সা চায়।
ওরাও জন্ম নিয়েছে। জন্মদিন আছে ওদেরও।
অথবা যারা ঠেলা টানছে- নর্দমা সাফ করছে বা আরও হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা নিজেদের জন্মদিন নিজেরাই মনে করতে পারে না- পারলেও কোন বিশেষত্ব খুঁজে পায়না-, তাদের সকলের সাথে কেমন যেন একসঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। কপালে ঘাম জমলো- শার্টের বোতাম খুললাম- চশমা খুলে চোখ পরিষ্কার করলাম, বুঝলাম অস্বস্তি হচ্ছে।
কেন চাপ নেবো- এত ভাবারই বা কি আছে। চিল ইয়ার!… কাঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে এসব ভাবতে পারলে বা ভাবাটায় বিশ্বাস করতে পারলে বোধহয় ভালো হতো।
উল্টোডাঙ্গায় রাস্তা পার হতে গিয়ে যখন নাজেহাল অবস্থা… প্রচণ্ড রোদ-ধোঁয়া-গরম-অস্বস্তি আর অসহায়তার মাঝে মনে হোল, আমি বড় হয়ে গেছি। হঠাৎ করে। শুধু অনেকগুলো জন্মদিন পেরিয়ে গেছে বলে নয়। বরং এই সংখ্যাগুলোর তাৎপর্যহীনতা বুঝতে পেরে।
আসলে জন্মদিন তো যেকোনো দিন হতে পারে। অথবা সবদিনই। যেদিন তুমি চাও। মাতৃগর্ভ থেকে থেকে জন্ম তো অতিস্বাভাবিক ব্যাপার। আদি অকৃত্তিম একটা জৈবিক ক্রিয়া। জৈবিক জন্ম নেওয়ার পর কতবার করে মরতে হয়। আবার সেখান থেকেই জন্ম নিতে হয়, সাহস করে বাঁচতে হয়।
জন্মদিন বোধহয় সেটাই অথবা সেইদিন- যেদিন সত্যিই ‘ফুঁ দিয়ে আলো নিভিয়ে’ খুশি হওয়ার নগন্যতা থাকবে না।
অথবা যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হবে- ভোর হওয়ার আগে আমার মৃত্যুদশার শেষ নিশ্বাস পড়ে গেছে, আজ থেকে আমার বয়স শূন্য থেকে শুরু।
Animeshonly is the founder of hojelive. He has been into theatrics & literature from a very tender age. Apart from producing new content and events for the brand, he loves gazing at the sky, seeping balck coffee and listening to the meows of his cat.